গত প্রায় ১৫ বছর ধরে উৎপাদনে নেই খুলনা অক্সিজেন কোম্পানিটির। তবে ঢাকা থেকে ভিন্ন কোম্পানি থেকে প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ কিউবিক মিটার অক্সিজেন এনে খুলনার প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে সরবরাহ করছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া লিন্ডে ও স্পেকট্রা কোম্পানিও খুলনা জেলাতে অক্সিজেন সরবরাহ করছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কোভিড ডেডিকেট হাসপাতাল, খুলনা জেনারেল হাসপাতাল, শহিদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সকল সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহকারী স্পেকট্রা অক্সিজেন কোম্পানি লিমিটেড।
এসব কোম্পানিগুলোর দাবি, খুলনার হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সরবরাহ সক্ষমতা রয়েছে তাদের। যদিও অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
নগরীর রূপসা স্ট্যান্ড রোড (শিপইয়ার্ড এলাকা) খুলনা অক্সিজেন লিমিটেড ও লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড নামে দুটি বেসরকারি অক্সিজেন কোম্পানি রয়েছে। ২০০৬ সালের ১২ ডিসেম্বর খুলনা অক্সিজেন লিমিটেডের বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার স্থাপনকালে অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্লান্টের রোটার কমপ্রেসার বিস্ফোরিত হয়েছিল। এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন ব্যবস্থা উৎপাদনে নেই। বর্তমানে খুলনা অক্সিজেন লিমিটেড, লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড ও স্পেকট্রা অক্সিজেন কোম্পানি নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান খুলনার বিভিন্ন স্থানে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করছে। খুলনায় নিজস্ব কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় ঢাকা, রূপগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে লিকুইড অক্সিজেন সংগ্রহ করে খুলনাতে সরবরাহ করা হচ্ছে।
বিভাগীয় শহর খুলনার সব কটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে এক সময় অক্সিজেন সরবরাহ হতো খুলনা অক্সিজেন কোম্পানি থেকে কিন্তু উদ্যোক্তার অনাগ্রহ, অর্থ সঙ্কট ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় সেই ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে বেসরকারি এ কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে বাইরে থেকে বোতলজাত অক্সিজেন এনে সরবরাহ করছে কোম্পানিটি।
খুলনা অক্সিজেন প্লান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, কোম্পানির অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ থাকায় এখন প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ কিউবিক মিটার অক্সিজেন সংগ্রহ করে খুলনার কয়েকটি হাসপাতাল-ক্লিনিকে সরবরাহ করছি। কারখানাটি পুনরায় চালু করতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। আমেরিকা প্রবাসী মালিক তানভীর মাশরু করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে আসতে পারছেন না। তিনি দেশে ফিরলে কোম্পানিটি উৎপাদনে যাবে কি না, সেটার সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
লিন্ডে বাংলাদেশের খুলনা ডিপোর একাধিক সূত্র মতে, কোম্পানিটি দুদিন পরপর রূপগঞ্জ থেকে ১৩০টি ছোট সিলিন্ডার ও ৫০টি বড় সিলিন্ডার নিয়ে আসছে। এতেই চাহিদার পর্যাপ্ত যোগান রয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি। আদ্বদীন মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল, খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নার্গিস মেমোরিয়াল হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল, গুড হেলথ, সুরক্ষা ক্লিনিক, সন্ধানী ক্লিনিকসহ ছোট-বড় অধিকাংশ হাসপাতাল ক্লিনিক লিন্ডে বাংলাদেশ থেকে অক্সিজেন নিয়ে থাকে।
লিন্ডে বাংলাদেশ খুলনার এরিয়া ম্যানেজার মো. মুশফিক আক্তার বলেন, এই মুহূর্তে চাহিদার তুলনায় আমাদের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। খুলনাবাসীর উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই।
একাধিক হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খুলনা অক্সিজেন কোম্পানি ও লিন্ডে বাংলাদেশের খুলনা ডিপো থেকে ক্রয় করে আমাদের হাসপাতালের চাহিদা পূরণ করা হয়। কিন্তু মাঝে মধ্যে এমন সঙ্কট দেখা দেয় তখন সমস্যায় পড়তে হয়। খুলনায় হাসপাতাল ও ক্লিনিক বাড়লেও নতুন কোনো অক্সিজেন কোম্পানি গড়ে না ওঠায় ক্রেতারা প্রায়ই ভোগান্তির শিকার হন। খুলনায় অক্সিজেন উৎপাদন ফের চালু হলে এই শিল্পে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দ্রুত সময়ে ক্রেতাদের অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হতো।
আরও পড়ুন: বেনাপোল বন্দর দিয়ে হঠাৎ করে জরুরি অক্সিজেন আমদানি বন্ধ
খুলনার সবগুলো সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহকারী স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড।
স্পেকট্রা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের এজিএম (খুলনা) ইঞ্জিনিয়ার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশের সবগুলো অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এ সংকট মোকাবিলা করবে ইনশাআল্লাহ। এখনো অবস্থা স্থিতিশীল। চাহিদার তুলনায় যোগান পর্যাপ্ত রয়েছে, উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই।
চিকিৎসকদের মতে, সাধারণ রোগীর শরীরে অক্সিজেনের উপস্থিতি ৯০ শতাংশের নিচে নামতে শুরু করলেই অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে। পালস অক্সিমিটার নামে একটি সহজ ডিভাইসের মাধ্যমে অক্সিজেনের শতকরা উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া যায়। অক্সিজেন যদি ৮০ শতাংশ বা এর আশপাশে থাকে তখন বাসায় রেখে অক্সিজেন দিয়েও সঙ্কট মোকাবিলা করা হয়। আর এর চেয়েও কমে গেলে তখন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন হবে।
এদিকে হঠাৎ করে ভারত থেকে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশে করোনার চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত জরুরি তরল অক্সিজেনের আমদানি। গত চার দিনে কোনো অক্সিজেনবাহী গাড়ি আসেনি। তবে গত ২১ এপ্রিলের আগে এক সপ্তাহে ৪৯৮ মেট্রিক টন ৮৪০ কেজি তরল অক্সিজেন ভারত থেকে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করে। যার আমদানি মূল্য প্রতি মেট্রিক টন ১৬৫ মার্কিন ডলার। ২৯টি ট্যাংকারে এই তরল অক্সিজেন বাংলাদেশে আসে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের শুধু বাণিজ্যিক সম্পর্ক না। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সূত্র ধরে এই ক্রান্তিকালে সীমিত পরিসরে হলেও দেশটি অক্সিজেন রপ্তানি সচল রাখবে।
জানা গেছে, দেশের চিকিৎসা খাতে অক্সিজেনের চাহিদার বড় একটি অংশ আমদানি হয় ভারত থেকে। প্রতি মাসে শুধু বেনাপোল বন্দর দিয়েই প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন অক্সিজেন আমদানি হয়ে থাকে। করোনাকালীন সময়ে আক্রান্তদের জীবন বাঁচাতে সম্প্রতি এ অক্সিজেনের চাহিদা আরও বাড়ছে। কিন্তু এরই মধ্যে বাংলাদেশে হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি।
আমদানিকারকরা জানান, ভারতীয় রপ্তানিকারকরা বলছেন, অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধে তাদের চাপ রয়েছে। তাই ভারতে ভবিষ্যৎ চাহিদার কথা ভেবে বাংলাদেশে অক্সিজেন রপ্তানি সাময়িক বন্ধ করেছে।
অক্সিজেন পরিবহনকারী বাংলাদেশি ট্রাক চালকেরা জানান, গত চার দিন ধরে বেনাপোল বন্দরে ট্রাক নিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু ভারত থেকে কোনো অক্সিজেন বন্দরে প্রবেশ করেনি।
অক্সিজেন আমদানিকারকের প্রতিনিধি রাকিব হোসেন জানান, ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা তাদের জানিয়েছেন সংকটের কারণে তারা বাংলাদেশে অক্সিজেন রপ্তানি করতে পারছেন না। এছাড়া রপ্তানি না করার বিষয়ে ভারত সরকারেরও কিছুটা চাপ রয়েছে।
বাংলাদেশ ভারত চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপ চলছে। এতে আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন অতি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে অক্সিজেন স্বল্পতা থাকলেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সোহার্দ্য সম্প্রতি ও বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তরল অক্সিজেন দেবে আশা রাখি।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসেসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, বাংলাদেশে চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রায় সবকিছুই আসে ভারত থেকে। হঠাৎ বন্ধে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তবে আমরা আশা করছি বন্ধুত্বের সূত্র ধরে ভারত সরকার করোনার এ সময়ে অল্প করে হলেও বাংলাদেশে অক্সিজেন সরবরাহ সচল রাখবে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আব্দুল জলিল জানান, সর্বশেষ ২১ এপ্রিলের আগে ৪৯৮ মেট্রিক টন ৮৪০ কেজি তরল অক্সিজেন ভারত থেকে বেনাপোল বন্দরে আমদানি হয়। প্রতি মেট্রিক টন অক্সিজেনের আমদানি মূল্য ছিল ১৬৫ মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি ১৪ হাজার ১৯০ টাকা।